মুহম্মদ আকবর:
নব্বইয়ের সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের নেতারা ৬ ডিসেম্বরকে স্বৈরাচার পতন দিবস হিসেবে বিবেচনা করেন। দীর্ঘ নয় বছরের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে গণঅভ্যুত্থানের মুখে ১৯৯০ সালের এই দিনে পতন হয় এরশাদ সরকারের। তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধ্য হন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তাই ৬ ডিসেম্বরকে গণতন্ত্র মুক্তি দিবস হিসেবে পালন করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। তবে জাতীয় পার্টির দাবি, কোনো চাপের মুখে পড়ে নয়, গণতন্ত্র তথা দেশের স্বার্থের কথা বিবেচনা করেই এইচএম এরশাদ সেদিন দেশের শাসনভার হস্তান্তর করেছিলেন। তাই জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি এ দিনটিকে সংবিধান সংরক্ষণ দিবস হিসেবে পালন করবে।
ঐতিহাসিক একই ঘটনা ঘিরে পৃথক পৃথক বার্তায় বিব্রত নতুন প্রজন্ম। তাদের ভাষ্য, ৬ ডিসেম্বরের ঘটনা সরাসরি না দেখলেও এর আদ্যোপান্ত সবারই জানা। তাই মীমাংসিত বিষয়ে অমীমাংসিত রাজনীতি কখনই জনগণের কল্যাণ বয়ে আনে না। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী তাবাসুস তামিমা আমাদের সময়কে বলেন, ‘‘দিবসটি নানাদিক বিবেচনায় ঐতিহাসিক এবং মীমাংসিত। এ মীমাংসিত বিষয়কে ‘সংবিধান সংরক্ষণ দিবস’ হিসেবে পালন করে অমীমাংসিত জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে জাতীয় পার্টি, যার প্রতিষ্ঠাতা স্বৈরাচার হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তরুণ প্রজন্ম তাদের এমন কাজে বিব্রত হয়। সচেতন মানুষও তাদের এ দিবস পালনকে গুরুত্বহীন মনে করে। তাই রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত ঐতিহাসিক এসব ঘটনায় বিভ্রান্তি ছড়ানো থেকে দূরে থাকা।’’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নব্বইয়ের সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের নেতা শফী আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, ‘নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সূচনা হয় ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ, যখন তৎকালীন সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অবৈধভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। সে সময় বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন বিচারপতি আবদুস সাত্তার। সেনাপ্রধান এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেই জারি করেন সামরিক আইন। আর সেই সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ করে ছাত্ররা।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে নানা অঘটন-ঘটনের নায়ক ছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। দেশের রাজনীতিতে যেসব ক্ষত ও দুর্বল স্থান আছে, সবই সৃষ্টি করে গেছেন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ও এরশাদ। আর এর জন্য সমাজকে মূল্য দিতে হয়েছে, এখনো হচ্ছে।’ শফী আহমেদ আরও বলেন, ‘১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর ব্যাপক গণআন্দোলনের মুখে সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তার পদত্যাগের পর বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন এবং জাতীয় সংসদ বাতিল হয়।’
নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের নেতা, আওয়ামী লীগের বর্তমান সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল অবশ্য এদিনে জাতীয় পার্টির দিবস পালনের বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘জাতীয় পার্টি বলতে চায় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ গণতন্ত্রের প্রয়োজনে বা সংবিধান রক্ষার প্রয়োজনে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছেন। গণতন্ত্রের প্রতি এ শ্রদ্ধাবোধ রাজনীতির মূল ধারায় আসার চেষ্টা। সে বিবেচনায় আমি তাদের বক্তব্যকে স্বাগত জানাই।’
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের বিশেষ সহকারী ও প্রেসিডিয়াম সদস্য মীর আবদুস সবুর আসুদ বলেন, ‘ওই দিন ক্ষমতা হস্তান্তর করা ছিল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। পরবর্তী সময়ে পল্লীবন্ধু দেশের গণতন্ত্র রক্ষায় নিরলসভাবে কাজ করেন। এরই ফলশ্রুতিতে মানুষ তার সেই অবদানের স্বীকৃতি দিয়েছে। সেই থেকে অবধি তিনি কোনোদিন নির্বাচনে পরাজিত হননি। তার দল তাই মানুষের কাছে সবচাইতে বেশি গ্রহণযোগ্য।’
এদিকে দিবসটিকে গণতন্ত্র মুক্তি দিবস হিসেবে আখ্যা দিয়ে বাণী দিয়েছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্বৈরাচার পতন ও গণতন্ত্র মুক্তি দিবস উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাণীতে বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ নব্বইপরবর্তী তিন দশকে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার রক্ষায় দায়িত্বশীল ভূমিকা রেখেছে। ২০০৯ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়ে আমাদের সরকার বিচারহীনতার সংস্কৃতি বন্ধ করে দেশে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আমরা গণতন্ত্র, সংবিধান, আইনের শাসন ও মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে অঙ্গীকারাবদ্ধ। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে অবৈধ ক্ষমতা দখলের পথ বন্ধ হয়েছে।’
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল তার বাণীতে বলেন, ‘১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচার পতনের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়েছিল বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনরায় পথচলা। শুরু হয় সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা। এদিনে গণতন্ত্রের দুশমনেরা পরাজিত হলেও আজও তারা চুপ করে বসে নেই। শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত গণতন্ত্র এখনো শৃঙ্খলমুক্ত নয়। নিষ্ঠুর কর্তৃত্ববাদী একদলীয় শাসনের শৃঙ্খলে বন্দি করে মানুষের নাগরিক স্বাধীনতাকে করা হয়েছে বিপন্ন। নামে-বেনামে একদলীয় ফ্যাসিবাদের আক্রমণে আক্রান্ত। ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী ও নিরঙ্কুশ করার জন্য আজ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছে।’
নব্বইয়ের ডাকসু ও সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের উদ্যোগে স্বৈরাচার পতন ও গণতন্ত্র মুক্তি দিবস উপলক্ষে আজ সকাল ১০টায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে আলোচনাসভার আয়োজন করা হয়েছে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সভাপতিত্ব করবেন ডাকসুর সাবেক ভিপি আমান উল্লাহ আমান। অন্যদিকে ৬ ডিসেম্বরকে সংবিধান সংরক্ষণ দিবস হিসেবে পালনের লক্ষ্যে আজ বেলা সাড়ে ১১টায় জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যানের বনানী কার্যালয় মিলনায়তনে বিশেষ আলোচনাসভা হবে। এতে সভাপতিত্ব করবেন পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের। আলোচনায় অংশ নেবেন জাপা মহাসচিবসহ পার্টির শীর্ষ নেতারা।